বর্তমান বাজারে ইলিশের দাম কত (২০২৫) ? প্রতি কেজি ইলিশের দাম কত

ইলিশ মাছ (Ilish Fish) কেবল একটি খাদ্যদ্রব্য নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও স্বাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে “মাছের রাণী” বা “রূপোলি শস্য” নামেও ডাকা হয়। প্রতি বছর বর্ষা এলেই বাজারে ইলিশের প্রাচুর্য আশা করা হয়। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজারে ইলিশের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির পাতে এই মাছের দেখা মেলা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌসুমের চূড়ায়ও অনেক সময় ইলিশের দাম অস্বাভাবিক চড়া থাকে। চাহিদা ও সরবরাহের জটিল সমীকরণে বাজারে ইলিশের বর্তমান দাম কত, কেনই বা এই অস্থিরতা— এই নিবন্ধে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

বর্তমান বাজারের চিত্র: অস্থিরতার পারদ চড়া

সাম্প্রতিক বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইলিশের দামে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে দামের তারতম্য ঘটলেও, মূল প্রজনন মৌসুমের আগে বা পরে বড় আকারের ইলিশের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়। সরকারি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয় বাজারে ইলিশের সরবরাহ বাড়লেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি ও উচ্চ চাহিদার কারণে দামের রাশ টানা যাচ্ছে না।

ট্যারিফ কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও ইলিশের দামের এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত চার মাসে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) ইলিশের দামে লক্ষণীয় উত্থান-পতন দেখা গেছে। এমনকি কেজিপ্রতি ইলিশের দাম ২,২০০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে দেখা গেছে, যা সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এক সময় যে দামে তিন কেজি ইলিশ পাওয়া যেত, এখন সেই দামে হয়তো এক কেজি গরুর মাংস কেনা যায়; আর বর্তমানে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি ইলিশের ভোক্তা থেকে শুরু করে সরকারকে পর্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

ইলিশের বর্তমান বাজার দর (প্রতি কেজি)

image 2

ইলিশ মাছের দাম তার আকার ও ওজনের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। যত বড় আকারের ইলিশ, তার দাম তত বেশি। মূলত ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশকে ‘পদ্মার ইলিশ’ হিসেবে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হয়।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই মূল্য তালিকাটি বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারের গড় দামের একটি ধারণা মাত্র। স্থান (ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল বা কলকাতা) এবং মাছের গুণগত মান (সতেজতা, ডিমযুক্ততা ও উৎস) অনুযায়ী দামে ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে।

ইলিশের ওজন (প্রতি কেজি)বাজার মূল্য (বাংলাদেশী টাকা – BDT)
ছোট আকারের ইলিশ (৪০০ – ৬০০ গ্রাম)১,০০০ – ১,৬০০ টাকা
মাঝারি আকারের ইলিশ (৭০০ – ৯০০ গ্রাম)১,৪০০ – ১,৯০০ টাকা
বড় আকারের ইলিশ (১ কেজি বা তার বেশি)১,৮৫০ – ২,৫০০ টাকা
প্রিমিয়াম ইলিশ (১.৫ কেজি বা তার বেশি)২,৬০০ – ৩,২০০ টাকা (বা তারও বেশি)

দাম নির্ধারণের মূল নিয়ামকসমূহ: কেন এত চড়া দাম?

ইলিশের দাম বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং সামগ্রিকভাবে বাজারকে প্রভাবিত করে।

১. আকার ও উৎসের ভিন্নতা (Size and Origin): ইলিশের দামের প্রধান নিয়ামক হলো এর আকার। বড় ইলিশ, বিশেষত ১ কেজির উপরেরগুলো, স্বাদে ও তেলে ভরপুর বলে এর চাহিদা ও দাম সর্বোচ্চ। ক্রেতাদের কাছে ‘পদ্মার ইলিশ’ বা ‘চাঁদপুরের ইলিশ’ নামে পরিচিত মাছগুলোর কদর বেশি, যার ফলে সেগুলোর দামও বেশি থাকে। সামুদ্রিক ইলিশের চেয়ে নদীর ইলিশের দাম সাধারণত বেশি হয়।

২. সরবরাহ ও মৌসুম (Supply and Seasonality): ইলিশের দাম মূলত সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান এবং জাটকা (ছোট ইলিশ) ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময় বাজারে সরবরাহ কমে যায়, ফলে দাম বাড়ে। আবার, যখন সাগরে বা নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে, তখন দাম কিছুটা কমে আসে। তবে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিলে দাম অস্বাভাবিকভাবে চড়ে যায়।

৩. মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব (Impact of Middlemen): ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইলিশের দামের পেছনে দাদন ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বড় ভূমিকা রয়েছে। জেলেরা যে দামে মাছ বিক্রি করেন, খুচরা বাজারে তা কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়। এই মধ্যবর্তী মুনাফার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে দাম অনেক বেড়ে যায়। কমিশন এই কারসাজিকে দাম বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

৪. উচ্চ চাহিদা (High Demand): বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে ইলিশের স্থান সর্বাগ্রে। বিশেষত উৎসবের সময়, যেমন পহেলা বৈশাখ বা দুর্গাপূজার আগে, ইলিশের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত চাহিদা দামকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

৫. রপ্তানি নীতি (Export Policy): সরকার প্রতি বছর সীমিত পরিমাণে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়, বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময়। যদিও রপ্তানির পরিমাণ কম, তবে এটি বাজারে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে, যা স্থানীয় বাজারে দাম বাড়াতে সাহায্য করে। মজার বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে এই ইলিশ বিদেশে রপ্তানি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগ ও সুপারিশ

ইলিশের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছে। ট্যারিফ কমিশন ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আকার অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশ কার্যকর হলে বাজারে দামের স্বেচ্ছাচারিতা কিছুটা কমতে পারে এবং ক্রেতারা তাদের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী ইলিশ কিনতে পারবেন। এছাড়া, দাদন চক্র ভেঙে দিয়ে প্রকৃত জেলেদের সহজে পুঁজি পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ পেঁয়াজের বর্তমান দাম (২০২৫) | প্রতি কেজি পেয়াজের দাম কত?

উপসংহার: স্বাদের ঐতিহ্য কি নাগালের বাইরে?

ইলিশ কেবল মাছ নয়, এটি বাঙালির একটি আবেগ। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে এই ঐতিহ্যবাহী মাছটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়লেও, বাজারজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থার ত্রুটি এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের অতি-মুনাফার লোভই এই অগ্নিমূল্যের প্রধান কারণ।

ইলিশের স্বাদ ধরে রাখতে হলে একদিকে যেমন মাছ ধরায় সরকারি নিয়ম-কানুনের সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি, তেমনই বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও আবশ্যক। ইলিশের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব না হলে, ভবিষ্যতে হয়তো এই মাছ কেবল ধনীদের পাতেই শোভা পাবে, যা নিঃসন্দেহে বাঙালির খাদ্য-ঐতিহ্যের জন্য এক বড় ক্ষতির কারণ হবে।

আমি ইলিয়াস আহমেদ একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, আমি অনলাইন ইনকাম, পেনশন, মোবাইল ব্যাংকিং, ব্যাংক লোন এবং প্রযুক্তির নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করি। আমার লেখায় সহজ এবং প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠকদের জন্য উপকারি তথ্য সরবরাহ করি, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে সহায়ক হয়। আমি প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করে সেই জ্ঞান সকলের সাথে ভাগ করে নিতে বিশ্বাসী।

Leave a Comment